একুশে পত্রিকা: কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িতদের ধরতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চলমান অভিযান বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী ও সচিবদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন অভিযুক্তরা। এমনকি অভিযান পরিচালনা করে আসা দুদক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত বা বদলি করার চেষ্টাও করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযােগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কক্সবাজারে চলমান ৭০টিরও বেশি প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ থেকে কমিশন বাণিজ্য’ করে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা টাকা হাতিয়ে নেয়া জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাংবাদিকসহ অন্তত ৬০ জনের বিরুদ্ধে উঠা অভিযােগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দুদকের তালিকায় নাম আসা ব্যক্তিরা নিজেদের বাঁচাতে যে যার মত ছুটে যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে। সেখানে গিয়ে তারা পরিচিত নেতাদের মাধ্যমে মন্ত্রী ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে দুদকের অভিযােগ থেকে মুক্তি পেতে
সহযােগিতা চাইছেন।
দুদকের তালিকায় নাম আসা কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের মাঝেও আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। তারাও উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে দুদকের অভিযােগ থেকে মুক্তি পেতে আকুতি জানাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, দুদকের তালিকায় নাম আসা কক্সবাজারের এক আলােচিত সাংবাদিক ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। ওই সাংবাদিক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে সাবেক শিবির নেতা বলে দাবি করেন এবং বেছে বেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযােগ করেন। জবাবে মন্ত্রী নির্দোষ কোন ব্যক্তি দুদকের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হবেন না এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কেউ রেহাই পাবে না বলে মন্তব্য করেন।
এছাড়া মুহিব উল্লাহ ও বাবর নামের কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ শাখার দুই শীর্ষ দালাল পৃথকভাবে ঢাকায় গিয়ে কয়েকজন মন্ত্রী ও ডজনখানেক সরকার দলীয় নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে কেউ এ পর্যন্ত তাদেরকে দুদকের তদন্ত থেকে নিজেদের নাম বাদ দেয়ার আশ্বাস দেয়নি।
কক্সবাজার আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, প্রভাবশালী এক সচিবের কাছে গিয়ে কক্সবাজারে অভিযানে নেতৃত্বদানকারী দুদকের কর্মকর্তা শরিফ উদ্দীনকে বদলির তদবির করেছিল একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। কিন্তু কক্সবাজারে দুদকের অভিযানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশ ও সমর্থন থাকায় সে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, কক্সবাজার চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণকে ঘিরে দুর্নীতিতে বিভিন্নভাবে জড়িত রয়েছে অন্তত দেড়শ’ দালাল। সেখানে জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিকের নামও রয়েছে। এ ছাড়াও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান ৫৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অধিগ্রহণ কেন্দ্রিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযােগ আছে। অনুসন্ধান ও গ্রেপ্তারকৃত সার্ভেয়ার এবং তিন দালালদের কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে দুদক।
তালিকা অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে এরমধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিল জাবেদ মাে. কায়সার নােবেলের ২১ কাটি টাকা জব্দ করেছে দুদক। নােবেলের নামীয় বেসিক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং ডাকঘর কক্সবাজার শাখা থেকে কয়েক দফায় এসব টাকা জব্দ করা হয়।
এ ছাড়াও কক্সবাজার শহরের অভিজাত হোটেল বেস্ট ওয়েস্টানে দুটি ফ্ল্যাট, ওয়ার্ল্ড বিচ হােটেলে একটি, আবাসিক বিল্ডিংয়ে একটি ফ্ল্যাট জব্দ, ইনানীতে থাকা ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকার জমির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে দুদকের তদন্ত টিম। নোবেলের বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় বিভিন্নভাবে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযােগ রয়েছে।
একইভাবে মিজানুর রহমানের ৪ কোটি টাকা জব্দ করেছে দুদক। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কক্সবাজার শাখায় অভিযান চালিয়ে মিজানুর রহমানের নামে এফডিআর করে রাখা ওই টাকা জব্দ করা হয়। মিজানুর রহমান সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের উত্তর মুহুরী পাড়ার মৃত আবদুল গণির ছেলে এবং কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমানের স্ত্রীর বড় ভাই।
দুদকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভিযানের অংশ হিসাবে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান তার পরিবার ও ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা মেহেদী হাসানের এ পর্যন্ত ৩৭ লাখ ৬০ হাজার ৩৯০ টাকা জব্দ করা হয়েছে। গত ১৪ ও ২১ সেপ্টেম্বর পৃথক অভিযানে বিভিন্ন ব্যাংকের কক্সবাজার শাখা থেকে এসব টাকা জব্দ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও গত ১৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে মেয়র মুজিবুর রহমানের ৮ দলিল জব্দ করা হয়। এর মধ্যে তিনটি ৩৩ লাখ ৯০ হাজার টাকায় বায়নাকৃত জমির দলিল, বাকি পাঁচটি আম মােক্তারনামা। জব্দ করা দলিলের জমির পরিমাণ ৮৭ দশমিক ৮৩ শতক। এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর পৌর মেয়র মুজিব ও তার পরিবারের ৬ কোটি টাকার সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের এই কর্মকর্তা।
যদিও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পৌর মেয়র মজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন জেলার আওয়ামী লীগ নেতারা।
কক্সবাজারে দুদকের অভিযান বন্ধে দৌড়ঝাঁপের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ একুশে পত্রিকাকে বলেন, দৌড়ঝাঁপ করলে অভিযান বন্ধ হবে না। এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জিরাে টলারেন্স অভিযানের অংশ।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি-জামায়াতের সময় রাষ্ট্রকে দুর্নীতিকরণ করা হয়েছিল, যা সমূলে উৎপাটন করা হচ্ছে। যেখানে দুর্নীতির খবর পাওয়া যাবে, সেখানে দুদকের হানা অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে কে কোন দলের নেতা কে কোন অফিসের সেটা দেখা হবে না। জড়িত কেউ রেহাই পাবে না।