ডেস্ক রিপোর্ট::
দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের এক কনষ্টেবলের সাথে প্রেমের পর বিয়ের প্রস্তাব তোলায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে কক্সবাজারের একটি প্রাইভেট কলেজের ছাত্রী। থানায় পুলিশের ব্যাপক মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ওই ছাত্রীর এখন চিকিৎসা চলছে।
উখিয়া থানার ওসিসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে এই ছাত্রীকে নির্মমভাবে নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। ওই ছাত্রীর বাড়ি মহেশখালী উপজেলায়। আর কনষ্টেবল হলেন কুমিল্লা জেলার হোমনা ইউনিয়নের হাসান আলীর ছেলে সুমন। কক্সবাজারের উখিয়া মরিচ্যা চেক পোস্টে দায়িত্বরত অবস্থায় ওই মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে সুমনের। সেই সম্পর্কের সূত্রধরে চলতি বছরের ৭ জুলাই (মঙ্গলবার) রাতে উখিয়া থানায় নির্মম পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয় ওই ছাত্রী।
এদিকে পুলিশের দাবী, মেয়েটি চরিত্রহীন। ব্ল্যাকমেইল করার জন্য নানা তালবাহানা শুরু করেছে। তাকে কোন ধরণের নির্যাতন করা হয়নি বলে ভয়েসওয়ার্ল্ডের কাছে দাবী করেন উখিয়া থানার ওসি মর্জিনা।
শনিবার (১১ জুলাই) দুপুরে ওই ছাত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের সূত্র ধরে পুলিশ কনষ্টেবল সুমনের সাথে তার সর্ম্পক হয় প্রায় এক বছর আগে। এরইমধ্যে তাদের বেশ কয়েকবার সরাসরি দেখা হয়। শারীরিক সর্ম্পকও হয়ে যায়।
মরিচ্যা চেক পোস্টে দায়িত্বের সুবাদে খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে সুমনসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকেন। সর্বশেষ ওই কক্ষেও সুমনের সাথে দেখা করতে যান ছাত্রী। সেখানেও তাদের শারীরিক সর্ম্পক হয়। এরপর থেকে কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধ রাখেন সুমন। যোগাযোগ বন্ধ রাখার এক পর্যায়ে ৭ জুলাই (মঙ্গলবার) সকালে কথা হয় সুমনের সাথে।
সুমনের কথা মতো উখিয়ার মরিচ্যায় যান তার প্রেমিকা। সেখানে তাদের বিয়ের ব্যাপারে অনেক কথা হয়। এরপর ছাত্রীকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বিকালের দিকে উখিয়ার ইনানী নিয়ে যান সুমন। সেখানে তারা উঠেন সুমনের কয়েকজন বন্ধুর কক্ষে। বন্ধুদের সামনেও তাদের বিয়ের বিষয়ে কথা উঠে। কথার এক পর্যায়ে সুমন ও তার প্রেমিকার মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। সেখানে তারা সিন্ধান্ত নেন মরিচ্যা গিয়ে কাজী ডেকে বিয়ে করবেন।
ফের ইনানী থেকে মরিচ্যার উদ্দেশ্যে রওনা হন তারা। মরিচ্যায় গিয়ে বিয়ের নামে নানা তালবাহানা শুরু করে সুমন। ৭ জুলাই রাত ১০ টার দিকে প্রেমিকাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায় সুমন।
ওই ছাত্রী আরও বলেন, “যখন সুমন রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায়; তখন রাত ১১ টার দিকে আমি কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন স্যারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে বিষয়টি অবগত করি। স্যার উখিয়া থানায় যোগাযোগ করে সেখানে যেতে বলেন। স্যারের কথায় আমি রাত সাড়ে ১১ টার দিকে উখিয়া থানায় হাজির হয়ে ওসি মর্জিনা আক্তারকে সব বিষয় খুলে বলি। বলার পর থেকে আমার উপর নির্যাতন শুরু করে।”
ছাত্রী বলেন, “প্রথম দফায় আমাকে ব্যাপক মারধর করেন ওসি নিজেই। এরপর দ্বিতীয় দফায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য (পুরুষ) আমাকে মারধর করে। পুলিশের ব্যাপক মারধরে আমার সারা শরীরে আঘাত হয়। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণও হয়। পুরো শরীর জুড়ে পুলিশি নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। হিজাব দিয়ে চোখ বেঁধে এবং হাত কড়া পরিয়ে মারধর করা হয়। পুরুষ পুলিশ সদস্যরা তলপেটে লাথি মেরেছে বেশি। যার কারণে পরনের জামাও রক্তাক্ত হয়ে যায়। শারীরিক নির্যাতনের সময় অনেক মন্দ গালিগালাজ করা হয়।
‘কনষ্টেবল সুমনের সাথে যোগাযোগ না রাখার হুমকি দিয়ে দফায় দফায় মারধর করা হয়। এমনকি ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে চালান করে দেওয়ার হুমকিও দেন ওসি। ইয়াবার কথা শুনে তাদের সব কথায় রাজি হয়। এর পরের দিন ৮ জুলাই (বুধবার) আমার বাবার সাথে যোগাযোগ করেন ওসি। বাবা উখিয়া থানায় এসে আমাকে নিয়ে যান। কিন্তু আমার মোবাইল ফোনটি রেখে দেন ওসি।’
তিনি বলেন, বাসায় এসে চকরিয়ার একটি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। ৯ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ডাক্তার দেখায় চকরিয়ার একটি হাসপাতালে। আঘাতের চিহ্ন দেখে ডাক্তারও রীতিমত অবাক হন।
কান্না জড়িত কণ্ঠে ওই ছাত্রীর মা জানান, আমার মেয়ে শত দোষ করেছে ঠিক আছে; তাই বলে এভাবে মারধর করতে হয়? কোনো মানুষ একজন মেয়েকে এভাবে মারে তা কল্পনা করতে পারছি না। তাও আবার থানার ভিতরে। মহিলা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের পুরুষ সদস্যরাও ব্যাপক মারধর করেছে। আঘাতের কষ্টে আমার মেয়ে এখন ঘুমাতে পারছে না, ঠিকমত বসতেও পারে না।
মায়ের প্রশ্ন দেশে কি আইন বিচার আছে? যারা আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করবে তাদের হাতে আজ আমার মেয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে নির্মমভাবে। আমি দোষিদের বিচার চাই। এমন নির্যাতন আমি কোনো দিন দেখিনি। আজ পুলিশের হাতে আমার মেয়েকে নির্যাতনের চিত্র দেখেছি।
ওই ছাত্রী বলেন, সুমন দেখে শুনে আমার সাথে সর্ম্পক করেছে। বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সর্ম্পকও করেছে। তাই বলে আমাকে এমন নির্যাতন করবে মেনে নিতে পারছি না। মহিলা ওসি নিজে মেরেছে ঠিক আছে; কিন্তু পুরুষ পুলিশের দ্বারা নির্মম মারধর করা হয়েছে। আমার শরীর দেখলে বুঝা যায় কেমন নির্যাতন চালিয়েছে পুলিশ। আমি এর বিচার চাই। বিচারের জন্য আমি সবধরণের আইনী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করব।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কনষ্টেবল সুমনের মোবাইল ফোনে একাধিক বার কল করা হলেও রিসিভ করেনি। সর্বশেষ প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে একটি ক্ষুদে বার্তাও প্রেরণ করা হয়েছে। এতেও সাড়া দেয়নি সুমন। যার কারণে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বক্তব্য পাওয়া গেলে তা গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হবে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্জিনা আক্তার মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেন। উল্টো ওই ছাত্রীকে চরিত্রহীন দাবী করে নানা মন্তব্য করেন। ওসি বলেন, ‘ওই নারী রাত ১১ টার দিকে অভিযোগ নিয়ে থানায় এসেছিল। পরে তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে কনস্টেবলের বিষয়ে দাপ্তরিকভাবে উপর মহলে জানানো হয়।’
ওসি বলেন, মেয়েটি অত্যন্ত খারাপ চরিত্রের। তার মোবাইলেও অনেক খারাপ খারাপ ছবি পাওয়া গেছে। এজন্য মোবাইলটি জব্দ করা হয়। পরের দিন সকালে পিতাকে ডেকে মেয়েকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। খারাপ চরিত্রের কারণে প্রথমে বাবা তার মেয়েকে গ্রহণ করতে চাইনি বলেও দাবী করেন ওসি।
এবিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, “ওই মেয়ে এবং কনষ্টেবলের বিষয়টি আমি কিছুটা অবগত আছি। তাদের সম্পর্ক মাত্র কয়েক দিনের। সম্পর্কের সুবাদে মেয়েটি ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করছিল। তথ্য নিয়ে জানা গেছে মেয়েটি এমন বেশ কয়েকটি ঘটনাও করেছিল অনেকের সাথে।
“ছেলের দোষ নেই তা বলা যাবে না। তবে থানায় মারধর বা নির্যাতনের বিষয়টি সত্য নয়। এবিষয়ে উখিয়া ওসির সাথেও কথা হয়েছে। কিন্তু থানায় এমন কোনো মারধর করা হয়নি। মেয়ের বাবাকে বুঝিয়ে মেয়েকে হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে মারধর করার বিষয়টি দেখছি না। হয়ত মেয়েকে বাসায় নিয়ে গিয়ে পরিবার কর্তৃক কোনো মারধরের শিকার হয়েছে কিনা তাও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। তারপরও বিষয়টি আরো খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এরইমধ্যে সুমন নামের ওই কনষ্টেবলকে রাঙ্গামাটি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
সূত্র: ভয়েসওয়ার্ল্ড24ডটকম।